পৃথিবীর ইতিহাসে দ্রুততম ১০ সাঁতারু: জলের বুকে যারা লিখেছেন গতি ও গৌরবের ইতিহাস

Category : , ,

জল এক আশ্চর্য মাধ্যম—এখানে শ্বাস নিতে হয় ভিন্নভাবে, শরীরকে চালাতে হয় প্রতিনিয়ত ভারসাম্যে, আর প্রতিটি মুহূর্তে গতি ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকতে হয় নিখুঁত। সেই জলে, কিছু মানুষ সৃষ্টি করেছেন এমন ইতিহাস, যা শুধু অলিম্পিকের পাতায় নয়, মানব সত্ত্বার সাহসিকতায় অমর হয়ে আছে। আসুন, জেনে নিই পৃথিবীর ইতিহাসে দ্রুততম ও সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০ জন সাঁতারুর কথা।


১. মাইকেল ফেলপস (Michael Phelps) – যুক্তরাষ্ট্র

মাইকেল ফেলপস নামটি যেন সাঁতারুদের জন্য এক জীবন্ত কিংবদন্তি। অলিম্পিক ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২৩টি স্বর্ণ পদক জয় করা এই ক্রীড়াবিদের রেকর্ড ভাঙার সাধ্য এখনো কারো হয়নি। তিনি একাধারে ১০০ ও ২০০ মিটার বাটারফ্লাই, ২০০ ও ৪০০ মিটার আইএম, ও ৪×১০০ মিটার রিলেতে অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন। তার শরীরের গঠন—দীর্ঘ বাহু, নমনীয় গাঁট, বড় ফুসফুস—সবকিছুই যেন পানির জন্যই তৈরি।

গৌরবময় মুহূর্ত: ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে একাই ৮টি স্বর্ণ জয়।


২. ক্যালেব ড্রেসেল (Caeleb Dressel) – যুক্তরাষ্ট্র

ফেলপসের অবসরের পর যিনি গতি ও প্রযুক্তির এক নতুন সংজ্ঞা দিয়েছেন, তিনি ক্যালেব ড্রেসেল। অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া সময়, বিস্ফোরক স্টার্ট এবং পানির ভেতরে স্লিপস্ট্রিমে তার দখল অনন্য। তিনি ২০২০ টোকিও অলিম্পিকে ৫টি স্বর্ণ পদক জিতে ফেলপসের উত্তরসূরি হিসেবে নিজের অবস্থান পোক্ত করেন।

বিশেষত্ব: ৫০ ও ১০০ মিটার ফ্রি-স্টাইল ও বাটারফ্লাইয়ে আধিপত্য।


৩. সিজার সিয়েলো (César Cielo) – ব্রাজিল

ব্রাজিলের সাঁতার ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম। ২০০৯ সালে ৫০ মিটার ফ্রি-স্টাইলে তিনি ২০.৯১ সেকেন্ডে এক অলৌকিক বিশ্বরেকর্ড করেন, যা আজও অপরিবর্তিত। তিনি ২০০৮ অলিম্পিকে স্বর্ণ জয় করেন এবং তার স্প্রিন্টিং দক্ষতা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়।


৪. ইয়ান থর্প (Ian Thorpe) – অস্ট্রেলিয়া

“থর্পেডো” নামে খ্যাত ইয়ান থর্প ছিলেন এক বিস্ময়। মাত্র ১৪ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক মঞ্চে পা রাখা এই সাঁতারু ২০০০ সিডনি অলিম্পিকে জাতীয় নায়ক হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে ২০০ ও ৪০০ মিটার ফ্রি-স্টাইলে তার কৌশল ও স্ট্যামিনা তাকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছিল।

চিহ্নিত বৈশিষ্ট্য: ডলফিনের মতো কোমল স্ট্রোক এবং সুনির্মিত ছন্দ।


৫. আলাইন বার্নার্ড (Alain Bernard) – ফ্রান্স

ফ্রান্সের হয়ে অলিম্পিকে সেরা পারফর্মারদের একজন। তার দৈহিক গঠন—চওড়া বুক, দীর্ঘ বাহু—তার গতি বাড়াতে সাহায্য করেছিল। ২০০৮ সালে ১০০ মিটার ফ্রি-স্টাইলে স্বর্ণ জিতে ইউরোপীয় গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।


৬. ফ্লোরেন্ট মানোদু (Florent Manaudou) – ফ্রান্স

আলাইন বার্নার্ডের উত্তরসূরি হিসেবে উঠে আসেন ফ্লোরেন্ট। ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে ৫০ মিটার ফ্রি-স্টাইলে স্বর্ণ জিতে সবাইকে চমকে দেন। তার স্টার্টিং ব্লক থেকে পানিতে ঢোকার সুনিপুণতা তাকে দ্রুততমদের তালিকায় স্থান দেয়।


৭. ম্যাট বিয়ন্ডি (Matt Biondi) – যুক্তরাষ্ট্র

১৯৮৪–১৯৯২ সময়কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে ১১টি অলিম্পিক পদক জয় করেন। বিশেষ করে ফ্রি-স্টাইল ও বাটারফ্লাইয়ে তার দ্রুততা এবং টেকনিক আধুনিক সাঁতারের ভিত্তি স্থাপন করে।

উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব: ১৯৮৮ সিউল অলিম্পিকে ৫টি স্বর্ণ জয়।


৮. আলেক্সান্ডার পোপভ (Alexander Popov) – রাশিয়া

৫০ ও ১০০ মিটার ফ্রি-স্টাইলে আধিপত্য ছিল ৯০-এর দশকে। তার স্ট্রোক এতটাই পরিপাটি ও মসৃণ ছিল যে তাকে বলা হত ‘জলের ভেতরে কবি’। তিনি দুই অলিম্পিকে (১৯৯২ ও ১৯৯৬) টানা স্বর্ণ জয় করেন।


৯. সান ইয়াং (Sun Yang) – চীন

চীনের প্রথম পুরুষ অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন সাঁতারু। তিনি ৪০০, ৮০০ ও ১৫০০ মিটার ফ্রি-স্টাইলে বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন। তবে তার ক্যারিয়ার নানা বিতর্ক ও ডোপিং অভিযোগে ছায়াচ্ছন্ন, তবুও দক্ষতা অস্বীকার করার উপায় নেই।


১০. কেটি লেডেকি (Katie Ledecky) – যুক্তরাষ্ট্র

নারী সাঁতারে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছেন কেটি। দীর্ঘ দূরত্বের ফ্রি-স্টাইলে তার টাইমিং অনেক সময় পুরুষ সাঁতারুদের কাছাকাছি চলে আসে। তিনি অলিম্পিকে ৭টি স্বর্ণসহ মোট ১০টি পদক জয় করেছেন, এবং এখনো সক্রিয় প্রতিযোগী।


শেষ কথা: জলের রাজারা

এই সাঁতারুরা কেবল টাইমিং নয়, আমাদের দেখিয়েছেন আত্মনিয়ন্ত্রণ, পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের পরাকাষ্ঠা। তারা সময়কে ছুঁয়েছেন গতি দিয়ে, এবং প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে চলেছেন। তাদের গল্প শুধু সাঁতারের নয়, বরং মানুষের সীমা অতিক্রম করার ইতিহাস।

magnifiercrossmenu