কাশ্মীর সংকটের ইতিহাস: এক জটিল অধ্যায়ের খোঁজে

Category : 

কাশ্মীর উপত্যকা—হিমালয়ের কোলঘেঁষা এক প্রাকৃতিক স্বর্গ, আজ পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, সহিংসতা ও রক্তাক্ত ইতিহাসের প্রতীক হয়ে। ভারত ও পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের বিরোধের কেন্দ্রবিন্দু এই অঞ্চল, যেখানে ভূখণ্ডের চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে মানুষের অধিকার ও আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন।

ব্রিটিশ উপনিবেশের শেষ দিনে

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় ব্রিটিশরা দেশীয় রাজ্যগুলোকে দুটি বিকল্প দেয়—ভারত অথবা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। কাশ্মীরের তৎকালীন মহারাজা হরি সিং ছিলেন হিন্দু, অথচ জনসংখ্যার বড় অংশ ছিল মুসলমান। তিনি শুরুতে স্বাধীন থাকার সিদ্ধান্ত নেন।

কিন্তু অক্টোবরে পাকিস্তান-সমর্থিত উপজাতি বাহিনী কাশ্মীরে আক্রমণ করলে তিনি ভারতের সাহায্য চান। ভারতের শর্ত ছিল, কাশ্মীরকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। হরি সিং সেই শর্ত মেনে ২৬ অক্টোবর ১৯৪৭ সালে “Instrument of Accession” স্বাক্ষর করেন এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীরে প্রবেশ করে।


প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ও জাতিসংঘের ভূমিকা (১৯৪৭-৪৮)

কাশ্মীর নিয়ে শুরু হয় প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। যুদ্ধের পর জাতিসংঘ যুদ্ধবিরতির ডাক দেয় এবং ১৯৪৯ সালে নিয়ন্ত্রণ রেখা (Line of Control) নির্ধারিত হয়। কাশ্মীরের এক-তৃতীয়াংশ পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে এবং বাকি অংশ ভারতের অধীনে চলে আসে।

জাতিসংঘ একটি গণভোটের প্রস্তাব দেয়, যাতে কাশ্মীরের মানুষ নিজের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে। কিন্তু সেই গণভোট আজও হয়নি, যা সংকটের অন্যতম মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।


পরবর্তী যুদ্ধ ও রাজনৈতিক উত্তেজনা

  • দ্বিতীয় যুদ্ধ (১৯৬৫): পাকিস্তান “অপারেশন জিব্রাল্টার” চালায়, যাতে কাশ্মীরে বিদ্রোহ ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ভারত তা প্রতিহত করে।
  • তৃতীয় যুদ্ধ (১৯৭১): মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘিরে হলেও যুদ্ধ শেষে শিমলা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেখানে কাশ্মীর সমস্যা দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সহিংসতা (১৯৮৯–বর্তমান)

১৯৮৯ সাল থেকে কাশ্মীরে শুরু হয় ব্যাপক সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদ। ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সাধারণ মানুষের দুর্দশা দীর্ঘস্থায়ী রূপ নেয়।


সংবিধান থেকে ৩৭০ ধারা বিলুপ্তি: নতুন মোড় (২০১৯)

৫ আগস্ট ২০১৯ সালে ভারত সরকার সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে, যার মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করা হয়। অঞ্চলটি দুইটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ হয়—জম্মু ও কাশ্মীর, এবং লাদাখ।

এই পদক্ষেপ ভারতকে প্রশাসনিকভাবে সুবিধা দিলেও কাশ্মীরের মানুষের আত্মপরিচয়, রাজনৈতিক অধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষাকে আরও জটিল করে তোলে। পাকিস্তান এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করে এবং আন্তর্জাতিক মহলেও বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে।


মানবিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি

কাশ্মীর সংকট কেবল একটি সীমান্তবিতর্ক নয়। এটি একটি জনগোষ্ঠীর জীবন, সংস্কৃতি ও স্বপ্নকে ঘিরে থাকা সংকট। রাজনীতি, সেনাশক্তি, ভূ-রাজনীতি—সব মিলিয়ে সংকটটি হয়ে উঠেছে এক বিস্ফোরক অধ্যায়।


কাশ্মীর সংকটের ইতিহাস আমাদের শেখায় যে, শুধু অস্ত্র বা ক্ষমতা দিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। প্রয়োজন সংলাপ, সহানুভূতি এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা।
একটি শান্তিপূর্ণ কাশ্মীর শুধু ভারত ও পাকিস্তানের জন্য নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্যই হতে পারে স্থিতিশীলতার প্রতীক।


আপনার মতামত কী? কাশ্মীর সংকট সমাধানে কীভাবে এগোলে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি আনা সম্ভব? মন্তব্য করে জানাতে ভুলবেন না।

magnifiercrossmenu