সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ১০ বাংলাদেশি (অরাজনৈতিক)

Category : 

বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, সমাজ ও বিজ্ঞানজগতে যেসব মানুষ তাঁদের অবদানে জাতিকে গর্বিত করেছেন, তাঁদের নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এই তালিকা। এই তালিকায় আমরা শুধু অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করেছি, যারা সৃজনশীলতা, মানবসেবা, জ্ঞানচর্চা ও সাংস্কৃতিক প্রভাব দিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে আলোড়িত করেছেন। নিচে তাঁদের সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো:

১. লালন সাঁই (১৭৭৪ – ১৮৯০)

বাংলা মরমি ভাবধারার কবি, দার্শনিক ও সাধক লালন সাঁই ছিলেন ধর্ম, জাতপাত ও সামাজিক ভেদাভেদের বিরুদ্ধে এক প্রাণবন্ত কণ্ঠস্বর। তিনি শুধু গান গেয়ে যাননি, গড়ে তুলেছিলেন এক অলঙ্ঘনীয় দর্শন, যেখানে মানুষের মধ্যে সাম্য, ভালোবাসা ও আত্মার মিলনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁর গানগুলো এখনো বাউল সংস্কৃতির প্রাণসত্তা।

তালিকায় থাকার যৌক্তিকতা: তিনি বাংলার চিন্তাধারায় মৌলিক এক বিপ্লব এনেছিলেন, যা আধুনিক কালের সমাজ-মনস্তত্ত্ব ও মানবতাবাদী দর্শনের পূর্বসূরি।

২. ড. মুহাম্মদ ইউনুস (জন্ম ১৯৪০)

গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা, ড. ইউনুস ক্ষুদ্রঋণের ধারণা দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচনের এক নতুন পথ দেখিয়েছেন। তাঁর আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মডেল শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের বহু দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে স্বনির্ভর হতে সাহায্য করেছে। তিনি ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন।

তালিকায় থাকার যৌক্তিকতা: তিনি অর্থনীতির মাঠে সামাজিক ব্যবসার ধারণা দিয়ে বিশ্বজুড়ে দারিদ্র্য বিমোচনের সংগ্রামে এক নতুন ধারা তৈরি করেছেন।

৩. জসীমউদ্দিন (১৯০৩ – ১৯৭৬)

‘পল্লীকবি’ হিসেবে খ্যাত জসীমউদ্দিন বাংলার গ্রামীণ জীবনের যে চিত্র তাঁর কবিতা ও গানে ফুটিয়ে তুলেছেন, তা এ দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের এক অপরিহার্য অংশ। কবর, সোজন বাদিয়ার ঘাট কিংবা নকশী কাঁথার মাঠ শুধু সাহিত্য নয়, আমাদের ঐতিহ্যও।

তালিকায় থাকার যৌক্তিকতা: বাংলার কৃষক, জেলে, পাট কাটার মেয়ে—সবাই তাঁর কাব্যজগতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে, যা তাঁকে বাংলার সাংস্কৃতিক মাটি থেকে গজিয়ে ওঠা এক অনন্য কণ্ঠে পরিণত করেছে।

৪. কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯ – ১৯৭৬)

বিদ্রোহী কবি নজরুল শুধু সাহিত্যে নয়, সংগীতে, ধর্মীয় সহিষ্ণুতায়, এবং উপমহাদেশের মুক্ত চিন্তায় বিপ্লব এনেছিলেন। ইসলাম ও হিন্দুধর্মের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে, তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয়ের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন। তাঁর গান, কবিতা ও গদ্য যুগে যুগে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা হয়েছে।

তালিকায় থাকার যৌক্তিকতা: তিনি ছিলেন বাঙালির প্রথম আধুনিক কণ্ঠ, যিনি জাতিকে শিখিয়েছেন প্রতিবাদ করতে, ভালোবাসতে এবং সাহসী হতে।

৫. ফজলে হাসান আবেদ (১৯৩৬ – ২০১৯)

ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদ ছিলেন আধুনিক বাংলাদেশে বেসরকারিভাবে উন্নয়নের সবচেয়ে শক্তিশালী কণ্ঠস্বর। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্র্যাক আজ বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও, যার কর্মসূচি কোটি মানুষের জীবনে পরিবর্তন এনেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী ক্ষমতায়ন—সবখানেই তাঁর প্রভাব সুদূরপ্রসারী।

তালিকায় থাকার যৌক্তিকতা: তিনি প্রমাণ করেছেন, সরকারি কাঠামোর বাইরেও উন্নয়ন সম্ভব—সৎ, দক্ষ ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে।

৬. জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯ – ১৯৫৪)

বাংলা কাব্যের নিঃসঙ্গ স্বপ্নদ্রষ্টা জীবনানন্দ দাশ ছিলেন প্রকৃতি, সময় ও মানবজীবনের অন্তর্যাত্রার কবি। তাঁর কাব্য জগত এক ধরনের মায়াময় নৈঃশব্দ্য ও পরাবাস্তব ভাবের ধারা তৈরি করেছে। রূপসী বাংলা, বনলতা সেন তাঁর কালজয়ী সৃষ্টি।

তালিকায় থাকার যৌক্তিকতা: তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার অন্তর্লৌকিক ধারা গড়ে তুলেছেন, যা পরবর্তী প্রজন্মকে চেতনাপথে প্রভাবিত করেছে।

৭. এস. এম. সুলতান (১৯২৩ – ১৯৯৪)

বাংলাদেশের চিত্রশিল্পে এক ব্যতিক্রমী কিংবদন্তি ছিলেন এস. এম. সুলতান। তাঁর চিত্রকর্মে বাংলার কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের অসামান্য শক্তি ও সৌন্দর্য চিত্রায়িত হয়েছে। তিনি পশ্চিমা রীতির বিপরীতে নিজস্ব ধারা গড়ে তুলেছিলেন।

তালিকায় থাকার যৌক্তিকতা: তিনি ছিলেন এক সাংস্কৃতিক যোদ্ধা, যিনি জাতির নিজস্ব রূপকে শিল্পে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন।

৮. জেমস (ফারুক মাহফুজ আনাম, জন্ম ১৯৬৪)

বাংলা রক সংগীতের ‘গুরু’ নামে পরিচিত জেমস তাঁর ব্যতিক্রমী কণ্ঠ, সুর ও গানের ভাষায় নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু করে আজও তরুণ প্রজন্মকে আন্দোলিত করছেন। নগরবাউল ব্যান্ডের মাধ্যমে বাংলা গানে এনে দিয়েছেন নতুন মাত্রা।

তালিকায় থাকার যৌক্তিকতা: তিনি বাংলা গানে আধুনিকতা, বিদ্রোহ, প্রেম ও নগরের জীবনের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে এক বৈপ্লবিক সংস্কৃতি তৈরি করেছেন।

৯. সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২ – ১৯৭১)

বাংলা সাহিত্যে মনস্তত্ত্ব ও আধুনিকতার সংমিশ্রণে অন্যতম পথিকৃত ছিলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। তাঁর উপন্যাস লালসালু গ্রামীণ ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এক দার্শনিক প্রতিবাদ। তিনি ভাষা ও চরিত্র নির্মাণে গভীরতা এনেছেন।

তালিকায় থাকার যৌক্তিকতা: তিনি সাহিত্যকে শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, সামাজিক বিশ্লেষণের এক যন্ত্রে রূপান্তর করেছিলেন।

১০. ড. কুদরত-এ-খুদা (১৯০০ – ১৯৭৭)

বাংলাদেশের বিজ্ঞানের জগতের অন্যতম পথপ্রদর্শক ছিলেন ড. কুদরত-এ-খুদা। বিজ্ঞান ও শিক্ষা ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয় শিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি বিজ্ঞানমনস্ক ও প্রগতিশীল শিক্ষা কাঠামোর খসড়া তৈরি করেন।

তালিকায় থাকার যৌক্তিকতা: তিনি ছিলেন জ্ঞানের প্রকৃত সাধক, যিনি বিজ্ঞান ও মানবকল্যাণকে একসূত্রে গাঁথার প্রয়াস চালিয়েছেন।


এই দশজন বাংলাদেশিকে শুধু তাঁদের কাজের জন্যই নয়, তাঁদের আদর্শ, সাহসিকতা এবং মানুষের জন্য ভালো কিছু করার অদম্য প্রয়াসের কারণে চিরকাল মনে রাখবে জাতি। তাঁরা বাংলা সংস্কৃতির মেরুদণ্ড, প্রেরণার বাতিঘর।

magnifiercrossmenu